সতী মন্দির সত্যের ধর্ম হয়ে ওঠার উদাহরণ
মন্দিরে মাটি নিবেদন! এক অনন্য ঐতিহ্য
প্রথম সন্তান হওয়ার পর অবশ্যই যেতে হবে এই মন্দিরে
অগ্নিদেব স্বয়ং দাদী সতীকে জানান বিদায়
৮০০ বছরের পুরনো দাদী সতীর মন্দির
নয়া দিল্লী।
সনাতন ধর্মকে পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ ও প্রাচীন ধর্ম বলে গণ্য করা হয়। এর যথেষ্ট কারনও রয়েছে, কারন সনাতন ধর্মে যে কোনো ব্যক্তি চাইলেই তপস্যা করে ঈশ্বরত্ব লাভ করতে পারেন। সনাতনের সারমর্ম হল, ঈশ্বর নিরাকার। এর মানে আমরা যে কোন জায়গায় ঈশ্বরকে খুঁজে পেতে পারি, তিনি আছেন সর্বত্র। গাছ, নদী, পাথর সবই এই ধর্মে পূজিত হয়। সনাতন ধর্মে এটা বিশ্বাস করা হয় যে সমস্ত জীবের মধ্যে ঈশ্বর বিরাজমান, প্রতিটি মানুষের মধ্যেই আছেন তিনি, জীবনের সবটুকু জুড়েই আছে ঈশ্বরের প্রতি ভক্তি। আজ আমরা আপনাদের এমন একটি মন্দিরের বিষয়ে জানাবো যে মন্দিরে পূজিত মাতা সতী সত্যের পরীক্ষায় নিজেকে সমর্পণ করে ঈশ্বরত্ব লাভ করেন এবং দেবী হয়ে উঠেন। আমরা আপনাকে এমন একটি মন্দির সম্পর্কে জানাবো যে মন্দির সত্যের উপর ভিত্তি করে ধর্ম হয়ে ওঠার উদাহরণ। দাদী, যিনি মুসলিম শাসকদের কু-প্রথার বিরোধিতা করেছিলেন, তিনি আজ পূজিত হচ্ছেন।
সত্য থেকে ধর্ম হয়ে ওঠার গল্প!
হরিয়ানার পানিপথের নারা গ্রামে অবস্থিত দাদি সতী মন্দিরের ইতিহাস প্রায় ৮০০ বছরের পুরনো। এই মন্দিরের ব্যাপক পরিচিতি রয়েছে স্থানীয় এলাকা গুলোতে। এই মন্দিরের গুরুত্ব বুঝতে পেরে, আমাদের “জানে আপনে মন্দির” টিমও সেই মন্দিরে পৌঁছে গিয়েছে। সেখানে আমরা দেখতে পাই, যে মুসলিম শাসকদের ভুল নীতির বিরুদ্ধে দাদী সতী তাঁর মৃত স্বামীর সাথে সতী হয়েছিলেন। তিনি সতী হওয়ার পর এই স্থানটি আধ্যাত্বিক হয়ে ওঠে পাশাপাশি মানুষের বিশ্বাসও এর প্রতি বাড়তে থাকে। পরে এখানে একটি মন্দির তৈরি করা হয় এবং তারপর থেকে আজ পর্যন্ত এই মন্দিরের মাহাত্ম্য এমন, যে দূর-দূরান্ত থেকে মানুষ এখানে আসেন, দেবীর দরশন করেন। বিশ্বাস করা হয় যে এখানে যে কেউ মন থেকে কোন কিছু চাইলে তা পূরণ হয়। নারা গ্রামের সৎপাল শর্মা আমাদের জানিয়েছেন যে, দাদী সতী সত্যের পরীক্ষায় নিজেকে সমর্পণ করেছেন এবং ঈশ্বরকে খুঁজে পেয়ে দেবী হয়েছিলেন।
মুসলিম শাসকদের কু-প্রথা, যার বিরোধিতা করে সতী হয়েছিলেন দাদীঃ
৮০০ বছরের পুরানো এই মন্দিরের সাথে সম্পর্কিত নানান তথ্য আমাদের সঙ্গে ভাগ করে নিয়েছে মন্দির কমিটির প্রধান তেজবীর’জী। তিনি জানান, এই মন্দিরের সাথে সম্পর্কিত সতী মাতার গল্পটি একজন মহিলার আত্মসম্মান এবং নারীবাদের সাথে সম্পর্কিত একটি গল্প, সমাজের বিরুদ্ধে তাঁর এমন লড়াই দেখে দেবতাদেরও পৃথিবীতে নেমে আসতে হয়েছিল। যখন দাদী, ধর্ম এবং নারীর সম্মানের জন্য তার স্বামীর চিতায় উঠে বসেন, তখন অগ্নি দেবতা স্বয়ং সেখানে আবির্ভূত হন এবং তাঁর এই বলিদানকে অমর করে তোলেন।
মন্দিরের প্রাচীন কাহিনী!
দাদী সতী মন্দিরের কাহিনী বহু প্রাচীন। মন্দিরের পুরোহিত সৎপাল শর্মার মতে, “এই কাহিনী মুসলিম শাসনের সময়ের। পাশের কবি গ্রামে এক মুসলিম রাজা বাস করতেন। আমাদের গ্রামে যে কোনো নারী বিবাহের পর নববধূ হয়ে এলেই প্রথম সেই নব বধুকে এক রাত সেই মুসলিম শাসকের বাড়িতে কাটাতে হতো। এই ছিল সেই মুসলিম শাসকের নোংরামি। দাদী ছিলেন ইউপির সিসোলি গ্রামের বাসিন্দা। তাঁদের বাগদান হয়েছিল এখানকার নারা গ্রামে এবং সেই মুসলিম শাসকের বোনের বিয়ে হয়েছিল সিসোলিতে। জল নিয়ে একবার দাদী এবং রাজার বোনের মধ্যে ঝগড়া হয়। ঝগড়ার মাঝে দাদীকে ঠাট্টা করে মুসলিম রাজার বোন বলেন, “বিয়ের পরতো এক রাতের জন্য তোমাকে আমার ভাইয়ের কাছে যেতে হবে।” এই কথা শুনে রাগে দুঃখে দাদী সতী তাঁর মাকে এই ঝগড়ার কথা জানান, কিন্তু কথা শোনার পরেও দাদীর মা কোনও প্রতিক্রিয়াই দেখাননি। মায়ের এই আচরণ দেখে দাদী সিদ্ধান্ত নেন যে তিনি কিছুতেই ওই মুসলিম রাজার বাড়িতে যাবেন না।
মুসলিম শাসকের সতীদাহ কুপ্রথার বিরোধিতাঃ
বিয়ের পর পালকি করে যাওয়ার সময় দাদি তাঁর পালকির লোকদের বলেন, আমার বিয়ে নাড়া গ্রামে হয়েছে, কবি গ্রামে নয়। আমার পালকি যাবে শুধুই নাড়া গ্রামে। সে সময় যদিও বহু মানুষ দাদীকে বুঝিয়েছেন কিন্তু তাতে লাভ হয়নি কিছুই। যাইহোক দাদীর পালকি তাঁর স্বামীর গ্রাম নাড়ায় গিয়ে পৌছায়। মুসলিম শাসক যখন এই খবর যখন জানতে পারলেন যে তাঁর শাসন লঙ্ঘন করা হয়েছে, তখন তিনি রাগে দাদীর স্বামীকে হত্যা করেন। স্বামীর মৃত্যুতে দাদী তখনই সতী হওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। স্বামীর সঙ্গে পাশের চিতার ওপর উঠে বসেন তিনি। মুসলমান সেই রাজার কু-প্রথার তীব্র প্রতিবাদ করে সতী হন। দাদীর এরূপ আচরণে স্বর্গ থেকে পৃথিবীতে নেমে আসেন স্বয়ং ব্রহ্মা। সৎপাল শর্মার মতে, দাদী যখন তাঁর স্বামীর সাথে শেষকৃত্যে চিতায় উঠে বসেন। তখন অগ্নিদেবের প্রভাবে অগ্নি স্বয়ংক্রিয়ভাবে সচেতন হয়ে উঠে এবং তিনি সতী হন। পরবর্তী সময়ে দাদীর স্বামীকে হত্যাকারী চরমপন্থীরাও একে একে প্রাণ হারায়। সেই সময় থেকে দাদী সতী সেই গ্রামের রক্ষক হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। গ্রামের মানুষের প্রতি কেউ কুদৃষ্টি রাখলে দাদী তাঁদের শাস্তি দেন। যাইহোক, সতী হওয়ার পর তাঁর নাম হয় দাদী সতী। এর আগে তাঁর নাম প্রচলিত ছিল না বলে মানুষ জানেন না। লোকে তাকে দাদী সতী নামেই চেনেন এবং পূজা করুন।
মন্দিরে মুসলমানদের প্রবেশ নিষিদ্ধঃ
দাদী সতীর মন্দিরে মুসলমানদের প্রবেশ নিষিদ্ধ। কেউ যদি নিজের পরিচয় গোপন করে মন্দিরে প্রবেশ করে তাহলে তার সঙ্গে ঘটে অপ্রীতিকর ঘটনা। স্থানীয় বাসিন্দা দিলওয়ার সিং জানান, “পরিচয় গোপন করে মন্দিরের সীমানা প্রাচীরের কাজ নেন এক ঠিকাদার। পরবর্তী সময়ে মন্দিরে প্রবেশ করলে তাঁর স্বাস্থ্যের অবনতি হতে থাকলে গ্রামের লোকজন তার আসল পরিচয় জানতে চাইলে সেই ঠিকেদার তার আসল পরিচয় জানায় এবং তিনি তৎক্ষণাৎ মন্দিরের সামনে দাদী সতীর কাছে ক্ষমা চাইলে তার জীবন রক্ষা পায়”।
মাটি নিবেদনের ঐতিহ্য রয়েছে মন্দিরে!
এই মন্দিরে মাটি নিবেদনের প্রথা বহুদিন ধরে চলে আসছে। কখন এবং কেন শুরু হয়েছে, এই গল্প গ্রামের মানুষের কাছে অজানা। তবে এটা নিশ্চিত করে বলা যায় যে, এই প্রথা দীর্ঘদিন ধরে চলছে। নদী বা পুকুরে স্নান করার পর মানুষ এক বা দুই মুঠো মাটি তুলে রাখেন, এই প্রথা কিন্তু বহু কাল আগের। গ্রামের প্রবীণদের মধ্যে আজও এই প্রথা চালু রয়েছে। মাটি নিবেদনের প্রথা প্রসঙ্গে নাড়া গ্রামের বাসিন্দা দিলওয়ার সিং বলেন, “এটা বহুদিন ধরেই চলে আসছে। মানুষ এখানে এসে মাটি নিবেদনের মাধ্যমে তারা তাদের দুঃখ দূর করে।”
দেয়াল চাটতে দেখা যায় এই মন্দিরে! রয়েছে ঐতিহ্যঃ
পানিপথের এই সতী মন্দিরে মাটি নিবেদনের পাশাপাশি দেওয়াল চাটারও এক অনন্য ঐতিহ্য রয়েছে। জাত-পাতের ভেদাভেদ ছাড়াই দীর্ঘদিন ধরে এই প্রথা মেনে আসছেন গ্রামের মানুষ। আসলে, মন্দিরের ভিতর লোকেরা তাঁদের জিভ দিয়ে দাদী সতীর মূর্তির সামনে নির্মিত একটি ছোট মন্দিরের দেয়াল চেটে দেয়। এবং দাদীকে তাদের মনকামনার কথা বলেন। দিলাওয়ার সিং-এর মতে, জাত-পাত ও অস্পৃশ্যতার ভেদাভেদ ভুলে এই মন্দিরের দেওয়াল চাটেন সকলে।
সন্তান হওয়ার পর অবশ্যই ভক্তরা আসেন মন্দিরেঃ
গ্রামবাসীদের বিশ্বাস দাদী সতী তাদের রক্ষাকর্তা। এই কারণেই গ্রামে যখন কারও প্রথম সন্তান হয়, সে প্রথমেই সন্তানকে নিয়ে যান দাদী সতী মন্দিরে। নবজাতক শিশু দাদী সতীর আশীর্বাদ পান। সৎপাল শর্মা জানান, গ্রামে যখন কারও প্রথম সন্তান হয়, সে অবশ্যই এখানে আসেন এবং দাদী সতীর আশীর্বাদ গ্রহণ করেন।
ইতিবাচক শক্তির কেন্দ্র দাদী সতী মন্দির!
হরিয়ানার পানিপথ জেলার নারা গ্রামের বিখ্যাত মন্দির, এই দাদী সতী মন্দিরটি ইতিবাচক শক্তির কেন্দ্র। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ঘেরা, এই মন্দিরে এসে যে কেউ পরম সুখের অভিজ্ঞতা লাভ করতে পারেন। মন্দিরের বাইরে গাছের সারি, বাতাসে গাছপালা দুলছে আর ফুল-পাতার গন্ধে ধূপ আর ধুনোর ধোঁয়ায় মন্দিরের পরিবেশ হয়ে উঠে আরও আধ্যাত্বিক। আর এই মনোরম পরিবেশের মধ্য দিয়েই মন্দিরে যাওয়ার পথ। মন্দিরের ভিতরে তৈরি করা হয়েছে ওম ও স্বস্তিক চিহ্ন। যার সঙ্গে জড়িয়ে আছে আগত ভক্তদের বিশ্বাস। দিলাওয়ার সিংয়ের মতে, “এখানে এলে মন শান্ত হয়ে যায়, এখানে এলে শক্তির অনুভূতি হয়। সেই সঙ্গে পূর্ণ হয় সকলের ইচ্ছা। এই গ্রামে হয় একটি বার্ষিক মেলাও,সময়ে সময়ে ভান্ডারার আয়োজন করা হয়। এই এলাকায় এই মন্দিরের এত বেশি পরিচিতি যে কোনও শুভ কাজ করার আগে এবং পরে, মানুষ অবশ্যই এখানে যান। শুধু তাই নয়, এখানে কুস্তির আয়োজনও করা হয়”।
কীভাবে পৌঁছবেন:
দাদী সতীর এই মন্দিরটি হরিয়ানার পানিপথের অসন্ধের নারা গ্রামে অবস্থিত। দিল্লী থেকে এর দূরত্ব প্রায় ১২৫ কিলোমিটার এবং পানিপথ থেকে ৩৩ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। সেখান থেকে লোকাল বাস কিংবা প্রাইভেট গাড়িতে সহজেই পাওয়া যায় এই মন্দিরে।
বিশেষ সম্পাদকীয়: যাইহোক, আমাদের প্ল্যাটফর্ম “জানে আপনে মন্দির” সতীকে প্রথার প্রচার করে না। আমরা বিশ্বাস করি এটা সমাজের কুফল। কিন্তু এই মন্দিরের কাহিনী আমাদের প্লাটফর্মে প্রচার করা হচ্ছে যেন দেশ ও বিশ্বের মানুষ জানতে পারে মুসলিম শাসকদের সময়ে নারীদের অবস্থা কি ছিল। অন্য ধর্মের মানুষের বিরুদ্ধে তাদের কী ধরনের নিয়ম ছিল। মুসলিম শাসকদের কুপ্রথার বিরুদ্ধে সতী হয়েছিলেন দাদী। আত্মসমর্পণের পরিবর্তে, তিনি গর্বের সাথে সত্যকে বেছে নিয়ে অমর হয়ে গিয়েছেন।