প্রতি ১২ বছরে একবার মহাদেবের উপর হয় বজ্রপাত!
শিবলিঙ্গের উপর বজ্রপাতের আসল রহস্য কি?
কেন শুধু এই শিবলিঙ্গের উপরেই হয় বজ্রপাত ?
কিভাবে জুড়ে যায় খণ্ডিত শিবলিঙ্গ?
হিমের আঁচল নামে প্রসিদ্ধ হিমাচল প্রদেশ,প্রাকৃতিক, সাংস্কৃতিক এবং প্রাচীন কাঠামোর জন্য বিখ্যাত। আজ হিমাচলের কুল্লু জেলার এমন এক অনন্য মন্দিরের কথা আপনাদের জানাবো, যা ভারতের প্রাচীনতম মন্দিরগুলির মধ্যে একটি। এই মন্দিরে প্রতি ১২ বছরে একবার হয় বজ্রপাত। সেই বজ্রপাতেই ভেঙ্গে যায় এখাণকার শিবলিঙ্গ। সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয়, খণ্ডিত শিবলিঙ্গে একটি বিশেষ পেস্ট প্রয়োগের পরে স্বয়ংক্রিয়ভাবেই পুরানো আকার ধারন করে শিব লিঙ্গ। এই মন্দিরের শিবলিঙ্গেই কেন প্রতি বারো বছর পর পর বজ্রপাত হয় তা এখনও বিজ্ঞানীদের কাছে রহস্যের বিষয়। কেন এমন বিস্ময় অন্য মন্দিরের শিবলিঙ্গে দেখা যায়না শুধু এই মন্দিরেই দেখা যায় এই বিস্ময়। তবে সনাতন ধর্মের বিভিন্ন পুস্তক ও প্রাচীন কাহিনীতে শিবলিঙ্গে বজ্রপাতের কারণ স্পষ্টভাবে বর্ণিত আছে। এই রহস্য উন্মোচন করতে, আমাদের “জানে আপনে মন্দির” -এর দল পৌঁছেছে বিজলী মহাদেব মন্দিরে। সেখান থেকে আমরা তুলে নিয়ে এসেছি বেশ কিছু তথ্য,যার ধর্মীয় গুরুত্ব রয়েছে অনেক।
বিজলী মহাদেবের মন্দির কোথায়? বজ্রপাতের রহস্য কি?
কুল্লু থেকে ১৮ কিলোমিটার দূরে কুল্লু উপত্যকার কাশওয়ারি গ্রামে ২৪৬০ মিটার উচ্চতায় মাথান নামক স্থানে ভোলেনাথের এই শিবলিঙ্গটি অবস্থিত। এই মন্দিরটি দেবাদিদেব মহাদেবকে উৎসর্গ করা হয়েছে। উঁচু পাহাড়ে অবস্থিত এই মন্দিরে রয়েছে পার্বতী ও ব্যাস নদীর সঙ্গম। প্রতি ১২ বছর পর এই মন্দিরে থাকা শিবলিঙ্গের উপর রহস্যজনকভাবে হয় বজ্রপাত। সর্বাত্মক প্রচেষ্টা সত্ত্বেও কোন বিজ্ঞানী এখন পর্যন্ত এর রহস্য খুঁজে বের করতে পারেননি। বজ্রপাতের জেরে মন্দিরে বিদ্যমান শিবলিঙ্গ ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যায়। সব চেয়ে আশ্চর্যের বিষয় হল এই বজ্রপাত শুধুমাত্র মন্দিরের উপরেই পড়ে এবং বজ্রপাত মন্দিরের শিবলিঙ্গের উপরেই আঘাত করে। মন্দির ছাড়া গ্রামের অন্য কোন জায়গায় এই বজ্রপাত হয়না। এই শিবলিঙ্গটিকে স্থানীয় লোকেরা মাখন মহাদেবও বলে, আবার কেউ এই শিবকে বিজলী মহাদেবও বলেন।
শুধু মাত্র এই শিব লিঙ্গেই কেন হয় বজ্রপাতঃ
এখানে সবচেয়ে বড় প্রশ্ন আসে, কেন প্রতিবার এই শিবলিঙ্গেই বজ্রপাত হয়? দেশে অসংখ্য শিবলিঙ্গ আছে কিন্তু বজ্রপাত হয় না। শুধুমাত্র বিজলী মহাদেবের মন্দিরে বজ্রপাত হয়। যদিও বিজ্ঞানীরা এখনও এর কারণ জানতে পারেননি। কিন্তু এর কারণ জানতে আমাদের ফিরে যেতে হবে বহু যুগ আগে। পৌরাণিক কাহিনি অনুসারে, হাজার বছর আগে এখানে কুলান্ত নামে এক রাক্ষস বাস করতো। যিনি ব্যাস নদীর জল বন্ধ করে দিয়েছিলেন, জল বন্ধ হওয়ায় সেখানে বসবাসকারী পশু-পাখি ও মানুষের জীবন বিপন্ন। এই দেখে মহর্ষি ব্যাস ভগবান শিবের কাছে পৌঁছান এবং তাঁর অনুরোধ শুনে ভগবান শিব তাঁর ত্রিশূল দিয়ে কুলান্তকে আক্রমণ করেন, যার ফলে তিনি মারা যান। বিশ্বাস করা হয় যে কুলান্ত অসুরের বিশাল দেহ পাহাড়ে পরিণত হয়েছিল এবং এই পর্বতে মহাদেব শিবলিঙ্গ রূপে সিংহাসনে অধিষ্ঠিত ছিলেন।
বজ্রপাতের পেছনে রহস্য কি?
কুল্লুর এই বিজলী মহাদেব মন্দিরে এই বজ্রপাত আজ থেকে নয়, শত বছর ধরে হচ্ছে। মন্দিরের গর্ভগৃহের ঠিক সামনে একটি লোহার স্তম্ভ রয়েছে। যা স্বয়ংক্রিয় বিদ্যুত সংগ্রহ করে পৃথিবীর অভ্যন্তরে প্রবাহিত করে। কখনও কখনও এই লোহার স্তম্ভ দিয়ে শিবলিঙ্গে পৌঁছে যায় বিদ্যুৎ। এই বজ্রপাত সরাসরি মন্দিরের চূড়ায় পড়ে। যার কারণে পুরো শিবলিঙ্গ খণ্ডিত হয়ে টুকরো টুকরো হয়ে যায়।
বজ্রপাত নিয়ে আসে ঐশ্বরিক আশীর্বাদঃ
স্থানীয়দের মতে, মন্দিরে হাওয়া বজ্রপাত তাদের জন্য এক ঐশ্বরিক আশীর্বাদ বয়ে আনে। গ্রামবাসীদের মতে, ভগবান এলাকার বাসিন্দাদের যে কোনো অমঙ্গল থেকে রক্ষা করেন। গ্রামবাসীদের রক্ষা করতে ভগবান শিব নিজের উপরেই নিয়ে নেন বজ্রপাত। অনেকেই বিশ্বাস করেন যে এই বজ্রপাত সকলের জন্য নিয়ে আসে ঐশ্বরিক আশীর্বাদ যার অনেক ক্ষমতা।
পৌরাণিক মান্যতাঃ
পৌরাণিক কাহিনী অনুসারে, এই বিশাল উপত্যকাটি একটি সাপের আকৃতির, যে সাপকে বধ করেছিলেন স্বয়ং মহাদেব। কথিত আছে, প্রতি ১২ বছর পর পর ভগবান ইন্দ্র, ভোলেনাথের আদেশানুসারে করেন বজ্রপাত। আর এই বজ্রপাতের কারণে ভেঙ্গে যায় মন্দিরের শিবলিঙ্গ। এর পরে, মন্দিরের পুরোহিতরা ভাঙা শিবলিঙ্গে মলম হিসাবে মাখন লাগালে মহাদেব ব্যথা থেকে মুক্তি পান। পৌরাণিক কাহিনীতে আরও বলা হয়েছে যে এই উপত্যকায় কুলান্ত নামক এক অসুর বাস করতেন। একবার সেই অসুর সমস্ত জীবকে হত্যা করার জন্য ব্যাস নদীর জল বন্ধ করে দিয়েছিলেন। তা দেখে অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হয়ে শিব, মায়ার সৃষ্টি করেন, এবং সেই অসুরের কাছে গিয়ে বললেন যে তার লেজে আগুন লেগেছে। শিবের কথা শুনে অসুর কুলান্ত পিছন ফিরে তাকাতেই ভগবান শিব অসুর কুলান্তের মাথায় ত্রিশূল দিয়ে আঘাত করেন এবং সেই আঘাতেই মৃত্যু হয় অসুরের। কথিত আছে যে এই মৃত অসুরের দৈত্যাকার দেহ পরবর্তী সময়ে একটি পাহাড়ে পরিণত হয়, যা আজ কুল্লুর পাহাড় নামে পরিচিত।
পৌরাণিক কাহিনী অনুসারে, কুলান্তকে হত্যা করার পর, ভগবান শিব ইন্দ্রকে প্রতি ১২ বছর পর পর এই স্থানে বজ্রপাত করার আদেশ দেন। মানুষের যেন কোন ক্ষতি না হয়, সেই কারনেই ভগবান ইন্দ্রকে এই আদেশ দেন ভোলেনাথ শিব। ভগবান নিজেই বজ্রপাত সহ্য করে তাঁর ভক্তদের রক্ষা করেন। কেউ কেউ আবার এও বিশ্বাস করেন যে, কুল্লু উপত্যকায় কুলান্ত নামে এক রাক্ষস বাস করতো। একদিন সে একটি বিশাল সাপের রূপ ধারণ করে এবং পুরো গ্রাম ঘুরতে ঘুরতে মাথান গ্রামে পৌঁছে যায়। কথিত আছে যে এই সময় তিনি ব্যাস নদীর প্রবাহ বন্ধ করার চেষ্টা করেন, যার ফলে সেই গ্রাম জলে প্লাবিত হয়। তখন ভগবান শিব অসুরের সাথে যুদ্ধ করে তাকে বধ করেন। সেই অসুরের মৃত্যুর পর সে একটি বিশাল পাহাড়ে পরিণত হয়। যার কারণে এই জায়গাটির নাম হয় কুল্লু।
কীভাবে জুড়ে যায় ভাঙা শিবলিঙ্গ!
মন্দিরের পুরোহিতরা বজ্রপাতের পর ভেঙে যাওয়া শিবলিঙ্গের অংশ গুলোকে জুড়তে গরুর দুধ থেকে তৈরি মাখন ব্যবহার করেন। যা মলমের মতো কাজ করে। মন্দিরের পুরোহিতরা ভেঙ্গে যাওয়া শিব লিঙ্গের প্রতিটি টুকরো সংগ্রহ করে নাজ, মসুর ডাল এবং লবণবিহীন মাখন দিয়ে তৈরি একটি পেস্ট ব্যবহার করে একত্রিত করে। আশ্চর্যজনক ভাবে কয়েক মাস পর সেই শিবলিঙ্গ সম্পূর্ণরূপে সংযুক্ত হয়ে যায়। দেখলে মনে হয় যেন আগের রুপে চলে গিয়েছে সেই শিব লিঙ্গটি।
মন্দিরের মহিমা অপারঃ
মন্দিরের গর্ভগৃহে প্রবেশ করলে ভক্তরা মাখনে মোড়ানো ভগবান ভোলেনাথের হলুদ শিবলিঙ্গ দেখতে পান। কথিত আছে যে ভগবান ভোলেনাথ সমস্ত বিপর্যয় নিজের উপর নিয়ে ভক্তের কল্যান করেন এবং তাঁর ভক্তদের সমস্ত কষ্ট থেকে দূরে রাখেন। সুউচ্চ পাহাড় ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের মাঝে বসবাস করেন বিজলী মহাদেব। বহু ভক্ত প্রতিদিন পৌঁছে যান বিজলী মহাদেবের এই মন্দিরে। ট্র্যাকিং প্রিয় মানুষদের কাছে এই জায়গাটি স্বর্গের চেয়ে কোন অংশে কম নয়। বিজলী মহাদেব মন্দির দেখতে যতটা সুন্দর, সেখানে পৌছনো ততটাই কঠিন। বিজলী মহাদেবের কাছে পৌঁছতে ভক্তদের পাড়ি দিতে হয় অনেক কঠিন পথ। ভক্তরা যতই বিজলী মহাদেব মন্দিরের দিকে যেতে থাকেন, ততই সেখানকার পরিবেশও বদলে যেতে শুরু করে। আপনি যত উপরে উঠবেন, ততই সেখানে বাড়তে থাকে ঠাণ্ডা, জঙ্গল হতে থাকে আরও ঘন। হাঁটতে হাঁটতে ভক্তরা যখন উপরে উঠতে থাকেন তখন সেখানকার নৈসর্গিক দৃশ্যগুলো সমস্ত ক্লান্তি দূর করে দেয়। পাহাড়ের চূড়ায় উঠলে, সেখান থেকে সমতলের দৃশ্য দেখায় অপূর্ব। এই দৃশ্য উপভোগ করতে করতে, ভক্তরা ছোট্ট একটি গেট দিয়ে প্রবেশ করেন বাবা ভোলেনাথের আবাসে। বিজলী মহাদেবের মন্দির চত্বরটিও খুবই সুন্দর করে সাজানো, একদিকে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য অন্যদিকে প্রাচীন শিবলিঙ্গ ও নন্দীর মূর্তি। যা আমাদের হাজার বছরের পুরনো ইতিহাসের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেয়। প্রতিদিনই এখানে আসেন বহু ভক্ত আর প্রত্যেকেই ভগবান শিবের এই মন্দিরে এসে প্রশান্তি লাভ করেন।
কিভাবে পৌঁছাবেন মন্দিরে –
হিমাচল প্রদেশের কুল্লু শহর থেকে প্রায় ২০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত এই মন্দির। ৩ কিলোমিটার ট্রেকিং করে পৌঁছানো যায় বিজলী মহাদেব মন্দিরে। দিল্লি থেকে ব্যক্তিগত গাড়ি কিংবা ট্যাক্সি করে কুল্লু পৌঁছতে পারবেন আপনি। হিমাচল প্রদেশ পরিবহনে এসি, ভলভো এবং সাধারণ বাসের ব্যবস্থা রয়েছে। কুল্লু-মানালিতে আসা পর্যটকরাও ঘুরে আসতে পারেন অবশ্যই এই মন্দিরটিতে।